পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৫ মে, ২০১২

যুক্তরাষ্টের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন: গুম-খুন নিয়ে শঙ্কা


যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কড়া সমালোচনা করেছে। ২০১১ সালের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা অযথা গ্রেফতার, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতনের ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে এই সমালোচনা করা হয়। ওই প্রতিবেদনে সরাসরি অভিযোগ করা হয়, গুম, হেফাজতে মৃত্যু ও হয়রানিমূলক গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়ী। এছাড়া প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তারা।

২৪ মে, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে নয়টায় যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত এই বাসরিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে ৪৩ পৃষ্ঠার বিস্তারিত পরিসরের প্রতিবেদনের সাতটি বিভাগে এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ এবং মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে দূরত্ব তুলে ধরা হয়। সবচে সমালোচনা করা হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন হত্যার।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন, সামাজিক সহিংসতা ও নারীর প্রতি বৈষম্য, আদিবাসীদের প্রতি সরকারি বৈষম্য ও সামাজিক সহিংসতা থেকে তাদের রক্ষায় ব্যর্থতা।
এ ছাড়া বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ, গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, সাংবাদিক নির্যাতন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সহিংসতা ঘটানো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত নিখোঁজ, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, অযথা গ্রেফতার, রিমান্ডে জীবনের হুমকি এবং দীর্ঘদিনের রিমান্ডের সঙ্গে জড়িত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দিয়েছে সরকার, যেখানে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ চালু রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সাংবাদিক হয়রানির কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়মুক্তিকে (ইমপিউনিটি) সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (্যাব) এই দায়মুক্তি পেয়ে থাকে! আর সে কারণেই নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মৃত্যুর ঘটনায় সরকার কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
্যাবের হাতে নিখোঁজ হওয়া দুইজন ব্যক্তি; বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুরের চাকরিজীবী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম-এর এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার সংস্থার সূত্র দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ্যাবের হাতে ৪৩ জন মারা গেছেন, গত বছর এই সংখ্যা ছিলো ৬৮

রাজনৈতিক সহিংসতা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, গত বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ২১৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১১৬ জন কারাগারে মারা যান। এসব মৃত্যুর অনেকগুলোই নির্যাতনের কারণে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে নেতা-কর্মী হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আগের বছরের তুলনায় গত বছর রাজনৈতিক সহিংসতা কিছুটা কমলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এমন ঘটনার প্রবণতা বাড়ে। প্রতিবেদনে অধিকারের বরাত দিয়ে বলা হয়, ধারণা করা হয় ২০১১ সালে রাজনৈতিক কারণে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের বছর তা ছিল ২২০। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যায় ২২ জন, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যায় তিনজন।

প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এর কিছু রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। কিছু ঘটেছে টাকাপয়সা ও স্থানীয় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে। অধিকারের বরাত দিয়ে বলা হয়, গত বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩০ জনকে গুম করার অভিযোগ ওঠে। এতে বিএনপির নেতা চৌধুরী আলম ২০১০ সালের জুনে গুম হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তাঁর পরিবার। তবে পুলিশ সে অভিযোগ অস্বীকার করে। বিএনপির ডাকা হরতালে বিএনপির সাংসদ ও চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক পুলিশের হামলায় আহত হন। প্রতিবেদনে ২০১০ সালের অক্টোবরে বিএনপির মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হামলায় নাটোরের বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর নিহত হন বলে উল্লেখ করা হয়।
অবাধ বাক স্বাধীনতা না থাকা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত সহিংসতা এখনো বাংলাদেশে সমস্যা হিসেবে রয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টেলিভিশন নামের দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রচারমাধ্যমে স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ এখনো চলছে।
বিচারব্যবস্থার ওপর ক্রমশ রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকায় তা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুচিত হচ্ছে।

গুম
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে বাংলাদেশে গুম ও অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনার অনেকগুলোর পেছনেই নিরাপত্তা বাহিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। তবে এই সময়ে গুম ও অপহরণের মোট সংখ্যা বলা হয়নি ওই প্রতিবেদনে।
যদিও অধিকারের (দেশের মানবাধিকার সংগঠন) হিসাবে, এই সময়ে ৩০টি গুমের ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। আর ২০১০ সালে এ ধরনের নয়টি ঘটনার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অভিযোগ ছিল।
পুলিশ কার্অত ‍অকার্যকর এবং তারা ক্ষমতাসীন দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা তদন্ত করতে চান না।

সীমান্তে সহিংসতা
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সীমান্তে চলমান সহিংসতা এখনো একটি সমস্যা হয়ে রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে ৩১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৭ জানুয়ারি সীমান্ত বেড়া পার হওয়ার সময় ১৫ বছরের ফেলানি খাতুনকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ।
ফেলানির মৃতদেহ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের আগে সীমান্তের কাটাতারের বেড়ায় পাঁচ ঘণ্টা ঝুলে থাকে তার লাশ।

শিশুদের প্রতি সহিংসতা এবং প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্য ছাড়াও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পরও নারীর প্রতি সামাজিক সহিংসতা বৈষম্য দূর হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

বিচারবিভাগে সরকারের রাজনীতিকরণকে সমস্যা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া সরকার সংসদের স্বাধীনতাও খর্ব করেছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। বলা হয়, বহুল-বিস্তৃত সরকারি পর্যায়ের দুর্নীতির কথাও। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সামাজিক সহিংসতা থেকে রক্ষায়ও শেখ হাসিনার সরকার ব্যর্থ উল্লেখ করে বলা হয়ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুরা সামাজিক সহিংসতার শিকার হয়েই চলেছেন
শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রিত অধিকার এবং শিশুশ্রম অনিরাপদ শ্রম-পরিবেশকে সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন