পাটের ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন॥ লাভবান হবে
বাংলাদেশ-ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার চাষীরা
২০ সেপ্টেম্বর, ঢাকা:
অনেক চড়াই-উৎড়াই পার হয়েছে, তারপরও উদ্ভাবন করা
যাচ্ছিলো না ঠিক কী কারণে পাট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। বাংলাদেশ পাট গবেষণা
কেন্দ্র এই নিয়ে চিন্তিত ছিলো যে, বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ
পাট নষ্ট হয় প্রতিবছরে। কিন্তু কেন, কী এর প্রতিকার। এবারে সেই সব প্রশ্নের
উত্তর দিলেন বাংলাদেশেরই এক বিজ্ঞানী, মাকসুদুল আলম। তার নেতৃত্বেই
উন্মচিত হলো পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবন রহস্য। এখন সেই ছত্রাক বিনষ্ট
করার কাজটাও খুব সহজ হলো।
এক সময় পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনও অনেকের কাছে
অধরা ছিলো কিন্তু বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানীই কিছুদিন আগে পাটের জীনন রহস্য (জিনোম) খুঁজে
পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের এই জিন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাটসহ
বিশ্বের ৫০০টি উদ্ভিদের অন্যতম শত্রু ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। তার মানেটা এমন,
ছত্রাক কীভাবে ফসলের জৈব উপাদান নষ্ট করে, উৎপাদন কমিয়ে দেয়, তা খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
মাকসুদুল বলেছেন; “ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের ওই ছত্রাকের আক্রমণে শুধু পাটই নয় বরং
দুনিয়াজুড়ে ৫০০টি উদ্ভিদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ছত্রাকের আক্রমণে শুধু পাটের উৎপাদনই ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদিও এতদিনে এই ছত্রাকের
কার্যপক্রিয়া জানা যাচ্ছিলো না। কিন্তু আমরা পেরেছি।”
তিনি বলেন, এখন কাজ বাকি অল্পই। ছত্রাকের আক্রমণ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে এমন জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষকের হাতে
পৌঁছে দেওয়া, ব্যস।
বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাটবিষয়ক মৌলিক ও
ফলিত গবেষণা প্রকল্পের আওতায় মাত্র এক বছরের মাথায় দেশের বিজ্ঞানীরা এই সফলতা
পেলেন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে এই প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত একটি গবেষণা
কেন্দ্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এই কাজ করেছেন।
এই সফলতায় বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন খোদ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি বুধবার সফলতার খবরটি
দেয় সরাসরি প্রচারিত জাতীয় সংসদের অধিবেশনেই। আর তাছাড়া একই দিন এই
সুখবরটি প্রকাশিত হয় বিশ্বের বিজ্ঞানবিষয়ক অন্যতম বিএমসি জেনোমিকসে।
মাকসুদুল আলম বলেন, এত অল্প সুযোগ-সুবিধা নিয়েও তার শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করায় এমন সফল হওয়া
গেছে। তিনি গবেষণায় আরও টাকা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানান।
পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করার এই সাফল্য
যেন বাংলাদেশ মালিকানা হিসেবে পায় (অর্থাৎ পেটেন্ট) তা নিশ্চিত তা নিয়েও অনেক কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এরই মধ্যে
পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মাকসুদুল জানান, স্বল্প পানিতে পাট ধোঁয়া ও জাগ দেওয়া বা পচানোর মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার
জন্যও তাদের গবেষণা চলছে। তবে এর জন্য কৃষকদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলেও জানান এই বিজ্ঞানী।
মাকসুদুল বলেন, “এই ছত্রাকটি ধান, গম, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, যবের মতো প্রধান
খাদ্য উৎপাদনকারী ফসলগুলোও নষ্ট
করে।”
উল্লেখ্য, বিশ্বের তিনটি ফসল, চারটি জীবাণুসহ মোট ১৯টি
জীবের জীবনরহস্য উন্মোচনে গবেষক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের এই কৃতী বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ ছাড়াও
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পেঁপে, মালয়েশিয়ার জন্য রাবার ও
বাংলাদেশের পক্ষে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করে এরই মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছেন
বাংলাদেশের মাকসুদুল।
মাকসুদুল আলম বলেন, “একসময় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার একটা বড় অংশই দিতো পাট। পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। অথচ আমাদের এই পাট
হারিয়ে গেলো। আমাদের পাট এবং পাটের প্রধান শত্রু ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে
আমরা পুনরায় আমাদের রাজত্ব উদ্ধার করতে পারবো। আমাদের কৃষকদের সোনালি দিন
ফেরত দিতে পারবো।”
তিনি বলেন, “এই কাজটি শুধু বাংলাদেশই নয় বরং পাশ্ববর্তী দেশগুলো যেখানে পাট উৎপান হয় যেমন ভারত, তারাও সুফল পাবে। কেননা, এসব অঞ্চলে পাটের শত্রু হিসেবে পরিচিত এই ছত্রাক।”
জানা গেছে, ২০ বছর আগে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাই সাদা আঁশের পাটের একটি লাইন (ঠিক জীবন নয়
বরং জীবনের একটা অংশ) উদ্ভাবন করেছিলেন। সেই পাট সাদা আঁশযুক্ত এবং তা ব্যবহার করতে
প্রক্রিয়াজাতকরণের দরকার হয় না; সরাসরি কাপড় তৈরিতে
ব্যবহার করা যায়।
মাকসুদুল আলম কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া
সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এত দিন জেনোমবিষয়ক যাবতীয় তথ্য উন্নত বিশ্বের
তথ্যভান্ডার থেকে শুধু সংগ্রহই করেছে। কিন্তু এখন সে তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের
অংশগ্রহণ থাকলো। বিশ্ব দেখবে আমরা শুধু তথ্য নিই না, দিতেও পারি।
পান্থ রহমান, ঢাকা`