সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে
অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ
জীবনযাপনের মৌলিক প্রতিটি অধিকার নিয়েই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকে দেশের মানুষ। এর
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাসস্থানের সমস্যা। বাড়িভাড়া এখন যন্ত্রণার আরেক নাম।
বেসরকারি একটি স্কুলের
শিক্ষক দেবাশীষ রায় বেতন পান সব মিলিয়ে আট হাজার টাকা। পল্লবীর ডি ব্লকের ৯ নম্বর
রোডের একটি ছোট্ট বাসায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন। হঠাৎ করে বাড়িওয়ালা দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। তিনি
এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেন। এরপর তাঁর বাসায় সন্ত্রাসী হামলা
হয়। কেটে
দেওয়া হয় বাসার বিদ্যুৎ ও পানির লাইন। এরপর দেবাশীষ রায় যান
আদালতে।
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে
বাড়িভাড়া নিয়ে এ রকম জিম্মিদশা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। নতুন বছর শুরুই হয় ভাড়া
বৃদ্ধির আতঙ্ক দিয়ে। এ জন্য আদালত পর্যন্ত যান অল্প কিছু
লোক। বাড়তি
ভাড়া দিতে না পারলে বাড়ি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া বাকিদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে
না।
দেশে বাড়িভাড়া
নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৯১ সালের একটি পুরোনো আইন আছে। আইনে বলা আছে, ভাড়াটের কাছে কোনো ধরনের জামানত বা
কোনো টাকা দাবি করা যাবে না। অগ্রিম হিসেবে এক মাসের ভাড়ার
অতিরিক্ত টাকা নেওয়া যাবে না। প্রতি মাসে ভাড়া পরিশোধের রসিদ দিতে
হবে।
কিন্তু আইনকানুনের ধার
ধারে না কেউ। আর আইন থেকেও নেই। একদিকে আইনটি উপযোগিতা হারিয়েছে, অন্যদিকে এর কোনো প্রয়োগও নেই। ভাড়াটেদের
অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা বিভিন্ন সংগঠনের অভিযোগ, সরকার বাড়িওয়ালাদের স্বার্থরক্ষার
জন্য বাড়িভাড়ার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন
অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ বছরে (১৯৯০-২০১১) ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে
প্রায় ৩৫০ শতাংশ। আর ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বাড়িভাড়া বেড়েছে ১৫ দশমিক
৮৩ শতাংশ। লাগামহীন এই বাড়িভাড়ায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।
ক্যাবের সভাপতি কাজী ফারুক
প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায়
গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাড়িভাড়া। ঢাকার মোট অধিবাসীর ৯০
শতাংশই ভাড়াটে। কিন্তু সরকার ভাড়াটেদের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বাড়িভাড়া
নিয়ে নামমাত্র যে আইন আছে, সেটি বাস্তবায়িত হয় না। কোন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে, সে ব্যাপারে আইনে কিছু বলা নেই। এটা
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের করার কথা। আর ঢাকা সিটি করপোরেশন সব বাড়ির
হোল্ডিং কর নির্ধারণ করে দেয়। কাজেই তাদেরই উচিত প্রতিটি বাড়ির
ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া। সিটি করপোরেশনের এমন একটি তালিকাও
আছে, কিন্তু সেটিও মানা হয় না।
ভাড়াটেদের সচেতন করতে ও
অধিকার আদায় করতে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া অধিকার সংরক্ষণ সোসাইটি। সংগঠনের
মহাসচিব কামরুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সরকারই উদ্যোগ
নেয়নি। জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইনেও বাড়িভাড়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত
হয়নি। ফলে বাড়িমালিকেরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন, বছর বছর ভাড়া বাড়াচ্ছেন।’ তিনি বলেন, এ-সংক্রান্ত
আইনটিও যুগোপযোগী নয়। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জেলা
প্রশাসকদের সম্মেলনে এই আইন সংস্কারের কথা আলোচনা হলেও এরপর আর কিছু হয়নি।
ক্যাবের জরিপ: ক্যাবের
জরিপ অনুযায়ী, ১৯৯০
থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩২১ দশমিক ০৬ শতাংশ। জরিপে
বলা হয়েছে, ১৯৯০
সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ছিল ২৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ২১ দশমিক ৬৫, ১৯৯২ সালে ১৩ দশমিক ৪৩, ১৯৯৩ সালে ১২ দশমিক ১৬, ১৯৯৪ সালে ১৬ দশমিক ৪৪, ১৯৯৫ সালে ২২ দশমিক ৬১, ১৯৯৬ সালে ১৭ দশমিক ৮৬, ১৯৯৭ সালে ১৫ দশমিক ০৩, ১৯৯৮ সালে ১৪ দশমিক ০৯, ১৯৯৯ সালে ১৮ দশমিক ২৪, ২০০০ সালে ১৫ দশমিক ০৮, ২০০১ সালে ১৭ দশমিক ৪০, ২০০২ সালে ১৩ দশমিক ৪৯, ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ৪০, ২০০৪ সালে ৯ দশমিক ৯৬, ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪, ২০০৭ সালে ২১ দশমিক ৪৮, ২০০৮ সালে ২১ দশমিক ০৭, ২০০৯ সালে ১৪ দশমিক ৮৫ এবং ২০১০ সালে
২০ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়িভাড়া বেড়েছে।
বাড়িওয়ালারা যা বলেন:
বেশির ভাগ বাড়িওয়ালার একই কথা। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে
যাওয়া, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার
বৃদ্ধি, দফায় দফায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বৃদ্ধি—এসব কারণেই বাড়িভাড়া বাড়াতে হচ্ছে।
ক্যাব বলছে, বাড়িওয়ালাদের ৮০ শতাংশই
বাড়িভাড়ার আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ কারণে কোনো কিছুর দাম সামান্য
বাড়লেই ভাড়া বাড়ান মালিকেরা। ক্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাড়া দিতে দেরি হলে রাজধানীর ২৮
দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়িওয়ালা ভাড়াটেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। গৃহহীন
মানুষের তুলনায় বাড়ির সংখ্যা কম হওয়ায় বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামতো ভাড়া
বাড়াচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়াসংক্রান্ত চুক্তি হয় না
বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের মধ্যে। বেশির ভাগ বাড়িওয়ালা ভাড়ার রসিদও
দেন না।
ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোডের
একজন বাড়িওয়ালা গিয়াসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছুর দাম বাড়লে বাড়িভাড়া
বাড়বে না কেন? ভাড়াটের
সঙ্গে চুক্তি করেন না কেন, জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেডের বাড়িওয়ালা গোলাম রায়হান বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাড়াটেরা
চুক্তিপত্র জাল করে মালিকানা দাবি করে বসেন। তাই অনেক মালিক ভয়ে চুক্তিপত্রের
কথা ভাবেন না। প্রতিবছর ভাড়া কেন বাড়ে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাড়া তো বাড়বেই। সরকার
তো কোনো আইন করেনি যে ভাড়া বাড়ানো যাবে না।
ঢাকা ভাড়াটিয়া উন্নয়ন
সোসাইটির মহাসচিব মাসুদ রানা বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়লে, তেলের দাম বাড়লে আমরা চিৎকার করি। কিন্তু ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড়
সমস্যার নাম বাড়িভাড়া। অথচ যখন-তখন ভাড়া বাড়ালেও কেউ কোনো
প্রতিবাদ করেন না।
বাড়িভাড়ার যন্ত্রণায়
চরম ক্ষুব্ধ ধানমন্ডির বাসিন্দা বেসরকারি একটি সংস্থার ব্যবস্থাপক কাজী মাহবুবুর
রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নগরের মানুষ সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণায় আছে বাড়িভাড়া নিয়ে। কিন্তু
সরকার এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। আমার মনে হয়, এখন কোন এলাকায় কত বাড়িভাড়া হবে, সেটি নির্ধারণ করে তা মানা হচ্ছে কি
না, তা পর্যবেক্ষণ করতে
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো উচিত।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকেরা
যা বলেন: বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা আছে, সরকার ভাড়া নির্ধারণসহ এ-সংক্রান্ত সব সমস্যা সমাধানের
জন্য নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দিতে পারবে। জানা গেছে, ঢাকায় এখন পাঁচ থেকে ছয়জন সহকারী
জজকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া আছে। তবে
সাধারণ মানুষ এটা জানে না। ফলে নিয়ন্ত্রকদের আদালতে যাওয়ার
সংখ্যাও হাতেগোনা। তা ছাড়া দেড় কোটি মানুষের এই শহরে পাঁচ-ছয়জন নিয়ন্ত্রকের
কী বা করার আছে।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক ও
সহকারী জজ ফারজানা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় ভাড়া নিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। বছর
বছর বাড়িভাড়া বাড়ছে। এমনকি আমাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা
ছাড়ার পর এক লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে বাসায় উঠতে হয়েছে। এ সমস্যার সুরাহা হওয়া
প্রয়োজন।
আরেকজন নিয়ন্ত্রক এ এফ এম
মারুফ চৌধুরী বলেন, ভাড়াটের
সঙ্গে বাড়িওয়ালার লিখিত চুক্তি করা আইনে বাধ্যতামূলক। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে
এই নিয়ম না মেনে মৌখিকভাবে সব চলে। ফলে ভাড়াটে চাইলেও আইনের আশ্রয়
নিতে পারেন না। আর ডিসিসির তালিকা অনুযায়ী, বাড়িওয়ালারা ভাড়া নিচ্ছেন কি না, সেটি তদারকের কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই
শুধু ভাড়া ঠিক করে দিলে হবে না, এটি মানা হচ্ছে কি না, সেটিও দেখতে হবে।
প্রশ্নবিদ্ধ বাড়িভাড়া আইন
দেড় কোটি মানুষের এই ঢাকা
শহরে বাড়িভাড়া দিন দিন বাড়ছে। তদারকির কেউ নেই। ফলে
আয়ের অধিকাংশই যায় বাড়িভাড়ায়। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন
থাকলেও তা কার্যকর নেই। ডিসিসির তালিকাও মানছে না কেউ। ভাড়াটের
সঙ্গে চুক্তির নিয়ম ও দুই বছরের মধ্যে ভাড়া বাড়ানোর নিয়ম না থাকলেও হরহামেশাই তা
হচ্ছে। বাড়িওয়ালাদের ৮০% বাড়িভাড়ার আয় দিয়ে চলেন। কোনো
কিছুর দাম বাড়লেই ভাড়া বাড়ান মালিকেরা। প্রতিবেদনগুলো তৈরি করেছেন শরিফুল
হাসান
কোনো ভাড়াটের কাছে জামানত
বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না বাড়িওয়ালা। এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া
নেওয়া যাবে না। প্রতি মাসে ভাড়া নেওয়ার রসিদ দিতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত
হবেন। দুই
বছর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো যাবে না। কেউ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে দ্বিগুণ
অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায়
এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে। শুধু ভাড়াটে নন, বাড়িওয়ালাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিও
আছে এই আইনে। তবে একটি বাসার ভাড়া কত হবে, সেটি নির্ধারণ করার বিষয়টি অত্যন্ত
ত্রুটিপূর্ণ এই আইনে।
১৯৯১ সালে সরকার আইনটি জারি
করে। দেশের
কোথাও এ আইন পুরোপুরি কার্যকর নেই। তা ছাড়া আইনটি যুগোপযোগীও নয়; বরং আইনে ভাড়া নির্ধারণের ধারাটি
প্রশ্নবিদ্ধ।
ঢাকা ভাড়াটিয়া উন্নয়ন
সোসাইটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী আবু কায়ছার প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯১ সালের আইনে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে—সবার মোটামুটি অধিকার সংরক্ষণ করা
হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী, ভাড়াটে বাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে
চুক্তি করবেন। ভাড়া কত টাকা, কত বছর পর ভাড়া বাড়বে—এসবই উল্লেখ থাকবে চুক্তিতে। প্রতি
মাসে ভাড়ার রসিদ দিতে হবে। বাড়িওয়ালা চুক্তি না করলে ভাড়াটে
তাঁকে আইনি নোটিশ দিতে পারবেন। হুট করে ভাড়া বাড়ানো হলে ভাড়াটে
আদালতে যেতে পারবেন। এর ফলে ভাড়া জমা হবে আদালতে। কিন্তু
সচেতনতা কিংবা সাহসের অভাবে ভাড়াটেরা আদালতে যান না।
ভাড়া কত হবে?: বাড়িভাড়া আইনের সবচেয়ে বড় সমস্যা, এ আইনে বাড়িভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণ
করতে গিয়ে ‘মানসম্মত
ভাড়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মানসম্মত
ভাড়া সম্পর্কে আইনের ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজারমূল্যের ১৫
শতাংশের বেশি হবে না।
বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া অধিকার
সংরক্ষণ সোসাইটির মহাসচিব কামরুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, আইনের এই ধারাটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কারণ, ১৯৯১ সালে আইনটি করার সময় একটি বাড়ি
নির্মাণের খরচ বর্তমানের তুলনায় অনেক কম ছিল। আবার তখন ফ্ল্যাটও সেভাবে
ছিল না। ফলে তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ শতাংশ ধরলে ঠিকই ছিল। কিন্তু
এখন একটি ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য যদি ৫০ লাখ টাকা হয়, তাহলে তার ১৫ শতাংশ আসবে সাড়ে সাত
লাখ টাকা। ১২ দিয়ে ভাগ করলে প্রতি মাসে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া আসবে
৬২ হাজার ৫০০ টাকা। এটি অবাস্তব। কাজেই আইনের এই ধারাটি যুগোপযোগী করে
এমন করতে হবে, যেন
ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালা—দুজনই
সেটি মানতে পারেন। এ ছাড়া আরেকটি সমস্যা এই আইন না মানলে কী হবে, সেটি কোথাও পরিষ্কার করে বলা হয়নি।
নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা ও
দায়িত্ব: বাড়িভাড়া আইনের ৩-এর ধারায় বলা হয়েছে, সরকার এই আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে কোনো এলাকার জন্য
নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করতে পারবেন। নিয়ন্ত্রক বাড়ির মালিক বা ভাড়াটের
দরখাস্তের ভিত্তিতে মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবেন। জজ আদালতে এ ধরনের
এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রক থাকলেও সাধারণ মানুষ তা জানে না।
ভাড়া বৃদ্ধির ওপর
বিধিনিষেধ: আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ানো হলেও তা আদায়যোগ্য হবে না। ধারা
৮-এ বলা আছে, বাড়ির
মালিক বাড়িভাড়া দেওয়ার পরও নিজ খরচে বাড়িটির এমন কিছু উন্নয়নসাধন করেন অথবা আসবাব
সরবরাহ করে থাকেন, যাকে
বাড়ি মেরামত বলা যায় না, তবে বাড়ির উন্নয়ন বলা যায়। এরূপ ক্ষেত্রে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটে
পরস্পর সম্মত হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবেন। এ ছাড়া বাড়ির পৌরকর, টোল ইত্যাদি বাড়লে ভাড়া বাড়তে পারে।
ভাড়া আদায়ের রসিদ: আইনের
১৩-এর ১ ধারা অনুযায়ী, বাড়ির মালিক ভাড়া পরিশোধের রসিদ দেবেন। রসিদের একটি অংশ অবশ্যই
বাড়ির মালিককে সংরক্ষণ করতে হবে। ঢাকা ভাড়াটিয়া উন্নয়ন সোসাইটির
মহাসচিব মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বেশির ভাগ বাড়িওয়ালা ভাড়ার রসিদ দেন না। আইন
অনুযায়ী এটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
সিটি করপোরেশনের তালিকা
অবাস্তব: বাড়ির বাজারমূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতিও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪-এ স্পষ্ট করা আছে। এটাকে
সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে
সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এতে ভাড়ার হার খুবই কম দেখানো
হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। যেমন, ধানমন্ডি এলাকায় মূল রাস্তার পাশে
একটি বাসার ভাড়া প্রতি বর্গফুট ৮ থেকে ১৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই
হিসাবে এক হাজার বর্গফুটের একটি বাসার ভাড়া হবে আট থেকে ১৩ হাজার টাকা। তা
ছাড়া সিটি করপোরেশনের এই তালিকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছু জানেও না।
অগ্রিম ভাড়া ও জামানত:
আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা আছে, ভাড়া দেওয়ার সময় অতিরিক্ত সালামি, জামানত বা অনুরূপ কোনো টাকা দাবি বা গ্রহণ করতে পারবেন
না। ভাড়াটিয়া
অধিকার সংরক্ষণ সোসাইটির মহাসচিব কামরুদ্দীন বলেন, এই আইন না মেনে ঢাকা শহরের অনেক
বাড়িওয়ালা ৫০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম নিচ্ছেন।
নিয়ন্ত্রকেরা যা বলেন:
ঢাকায় এখন মোট ১০ জন বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক রয়েছেন। তাঁরা সবাই সহকারী জজ। তবে
ঢাকার বেশির ভাগ ভাড়াটে আইন সম্পর্কে না জানার কারণে এই নিয়ন্ত্রকদের আদালতে যান
না। ঢাকার
একজন বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান আইনে ভাড়ার হার নির্ধারণ
থেকে শুরু করে অন্য সব সুবিধাই পাবেন বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেরা। আইন অনুযায়ী, বাড়িওয়ালারা দুই বছরের মধ্যে ভাড়া
বাড়াতে পারবেন না। দুই বছর পর ভাড়া বাড়ালেও উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে ভাড়া
বাড়াতে হবে। কেউ সেটা না মানলে ভাড়াটের সেই ভাড়া মানসম্মত মনে না হলে তিনি
আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
আদালতে রিট: বাড়িভাড়া
নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে গত বছরের ২৬ এপ্রিল জনস্বার্থে একটি রিট করেন বেসরকারি
সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি মনজিল মোরসেদ। রিট
আবেদনের শুনানিতে আদালতকে তিনি বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়ার তালিকা
অনুসারে ভাড়া আদায়ে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এই আইন অনুসারে বিধিমালা
প্রণয়নের বিধান থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে বাড়ির মালিকের বেআইনি কর্মকাণ্ডে
ভাড়াটেরা অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল করা
এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকরের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে
না, জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি
রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রিট আবেদনকারী মনজিল মোরসেদ প্রথম
আলোকে বলেন, ‘কোন
এলাকার ভাড়া কত হবে, তা
সুনির্দিষ্ট করে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করুক, এটি কার্যকর হোক—সেটাই রিট আবেদনে চাওয়া হয়েছে।
পুরোনো আইন: বাড়িভাড়া
নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। পরের বছর বাড়িভাড়া
নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, যা দেশ স্বাধীনের পরও ১৯৮৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত
বলবৎ ছিল। ১৯৮৬ সালে বাড়িভাড়া
নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৬৩ সালের অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর
মেয়াদ ছিল তিন বছর এবং তা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি
সাহাবুদ্দীন আহমদ বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ জারি করেন। এ আইনে কোনো মেয়াদের কথা
উল্লেখ নেই।
আইনের কোন ধারায় কী আছে
১৫.১ ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট
বাড়ির বাজারমূল্যের ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ হিসেবে একটি ফ্ল্যাটের দাম ৫০ লাখ
টাকা হলে মাসিক ভাড়া হবে ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু এই টাকায় সহজে কেউ বাসাভাড়া
নেবে না।
১০ ধারায় বলা আছে, ভাড়া দেওয়ার সময় অতিরিক্ত সালামি, জামানত বা অনুরূপ কোনো টাকা দাবি বা
গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু হরহামেশাই সেটি হচ্ছে। এ
ছাড়া অগ্রিম ভাড়া হিসেবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দাবি বা গ্রহণ করতে পারবেন
না। নিলে
অর্থদণ্ড হবে। আইন থাকলেও এটি দেখার কেউ নেই।
৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার বেশি
নেওয়া যাবে না। বেশি নিলে আদালতে যাওয়া যাবে। তবে মানসম্মত ভাড়া সহজে
ঠিক করা যায় না।
১৩.১ ধারা অনুযায়ী, বাড়ির মালিক ভাড়া পরিশোধের রসিদ
ভাড়াটেকে দেবেন। রসিদের একটি অংশ অবশ্যই বাড়ির মালিককে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভাড়া বেড়েছে সব এলাকায়
বাড়িভাড়া বাড়ে এলাকাভেদে। স্কুল
আছে এমন এলাকায় বাসাভাড়া সব সময়ই বেশি। ভাড়া বাড়েও দ্রুত। স্বল্প
আয়ের মানুষ আগে একটু দূরে থাকতেন। রেহাই পাচ্ছেন না তাঁরাও।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার
ভাড়াটেরা জানিয়েছেন, তিন
বছর আগেও যে বাসার ভাড়া ছিল ছয় হাজার টাকা, সেটি এখন ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। যে বাসা ছিল ১০ হাজার টাকা, সেটি এখন ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এই
অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি সরকার।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের
তাজমহল রোডের একটি বাসার ভাড়াটে রিয়াজ রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আট
হাজার টাকায় দুই কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। এখন সেটির ভাড়া ১২ হাজার। খাই
বা না খাই, মাস
শুরু হলেই বাড়িওয়ালাকে এই ১২ হাজার টাকা দিয়ে দিতে হবে। আমার আয়ের ৬০ শতাংশই চলে
যায় বাড়িভাড়ায়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর
হাউজিং লিমিটেডের ৪ নম্বর রোডের বাসিন্দা সানজীদা শারমিন ১১ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি
বাসায় উঠেছিলেন। এক বছর পর বাড়িওয়ালা সেটি ১২ হাজার করেন। আরও এক বছর পর সেই বাসার
ভাড়া এখন ১৪ হাজার টাকা। বাসা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী
এলাকার ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই বছরে এই এলাকায় বাড়িভাড়া দুই থেকে চার হাজার
টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে এই এলাকার রাস্তাগুলো
সম্প্রতি ভালো হয়েছে। আর এর পরই পাল্লা দিয়ে বাড়িভাড়া
বাড়ছে। স্কুল বেশি থাকায় এসব এলাকায় এমনিতেই ভাড়া বেশি। ভাড়া
বাড়েও বেশি।
রাজধানীর পল্লবীর বাসিন্দা
তারাজুল ইসলাম বলেন, ‘নগরের
স্বল্প আয়ের অনেকেই একটু কম ভাড়ায় একসময় মিরপুর ও পল্লবীতে থাকতে পারতেন। কিন্তু
মিরপুরেও এখন বাসাভাড়া বেড়েছে। দুই বছর আগেও দুই কক্ষের একটি বাসায়
আমি সাত হাজার টাকায় থাকতাম। কিন্তু এখন সেটি হয়ে গেছে ১০ হাজার
টাকা।
কাজীপাড়ার দক্ষিণ মনিপুর
এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এই এলাকায় বর্ষায় পানি জমে বলে ভাড়া একটু কম ছিল। কিন্তু
এখানেও বাসাবাড়া বেড়ে চলেছে।
মিরপুর ও পল্লবী এলাকার
ভাড়াটেরা জানিয়েছেন, এসব
এলাকায় গত দেড় বছরে ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে।
ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের
একটি বাড়িতে থাকেন বহুজাতিক একটি কোম্পানির কর্মকর্তা রাশেদুল হাফিজ। উঠেছিলেন
২১ হাজার টাকায়, এক
বছরে সেটি হয়েছে ২৫ হাজার টাকা।
ধানমন্ডি ও কলাবাগান
এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এক বছরের ব্যবধানে এই এলাকায় বাড়িভাড়া তিন থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত
বেড়েছে।
ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বলে
জানা গেছে, রাজধানীর
গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায়
গত এক বছরে চার থেকে সাত হাজার; রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী এবং আজিমপুর, লালবাগ, কোতোয়ালি এলাকায় এক থেকে তিন হাজার; বাসাবো, গোপীবাগ, খিলগাঁও ও সবুজবাগ এলাকায় ৫০০ থেকে
দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িভাড়া বেড়েছে।
বাড়িভাড়ার যন্ত্রণার
সবচেয়ে করুণ শিকার হচ্ছেন তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প কারখানার শ্রমিক ও
নগরের নিম্নবিত্ত মানুষ। ডিসিসির বস্তি উন্নয়ন বিভাগ জানিয়েছে, এঁদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ, যা নগরের মোট জনসংখ্যার ৩৩ দশমিক ৩৩
শতাংশ। বছর দশেক আগে শ্রমিকেরা অনেকে মিলে আধা পাকা বাসায় থাকতে
পারতেন। এখন মিরপুর, বাসাবো, তালতলা
ও শেওড়াপাড়া এলাকার একেবারে শেষ মাথার গলিতে দুই কক্ষের আধা পাকা টিনশেডের
বাসাভাড়া পাঁচ হাজার, সাড়ে
পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।
বেতনের সঙ্গে সংগতি নেই বাড়িভাড়ার
বাড়িভাড়া এখন বেতনের সঙ্গে
প্রায় পুরোটাই সংগতিহীন। বেতনের বড় অংশই চলে যায় বাড়িভাড়ায়। অথচ
বেতন যে হারে বাড়ে, বাড়িভাড়া
বাড়ে তার চেয়েও বেশি। এতে বাড়িভাড়ার সঙ্গে বেতনের অসংগতি
কেবলই বাড়ছে।
কামরুল ইসলাম অর্থনৈতিক
ক্যাডারের একজন সরকারি কর্মকর্তা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল বেতন স্কেল ১১ হাজার। বাড়িভাড়া
ঢাকার বাইরে মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ। ঢাকায় ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ। ঢাকায়
আমরা সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাসাভাড়া পাই। এখন একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা এই
টাকায় কীভাবে বাসাভাড়া পাবেন, কীভাবেই বা চলবেন?
বর্তমানে সরকারি
বেতনকাঠামো অনুযায়ী, প্রথম
শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তিনি বেতন পান
১৮ হাজার টাকা। প্রভিডেন্ট ফান্ড কাটলে বেতন এক হাজার টাকা কম। অথচ
দুই কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিতে হলেও ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাগে। এ
কথা জানিয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করার জন্যই সরকারের উচিত বাড়িভাড়ার লাগাম
টেনে ধরা।
জাতীয় বেতন স্কেল, ২০০৯ অনুযায়ী, স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের
যেসব কর্মকর্তার মূল বেতন পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত, তাঁরা বেতনের ৬৫ শতাংশ হারে ন্যূনতম
দুই হাজার ৮০০ টাকা বাড়িভাড়া পান। আর যাঁদের মূল বেতন পাঁচ হাজার এক
টাকা থেকে ১০ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত, তাঁরা ন্যূনতম তিন হাজার ৩০০ টাকা বাড়িভাড়া পান। যাঁদের
মূল বেতন ১০ হাজার ৮০১ টাকা থেকে ২১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত, তাঁরা মূল বেতনের ৫৫ শতাংশ হারে
ন্যূনতম ছয় হাজার ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া পান। আর ২১ হাজার ৬০১ টাকার ঊর্ধ্বে
যাঁদের বেতন, তাঁরা
৫০ শতাংশ হারে ন্যূনতম ১১ হাজার ৯০০ টাকা বাড়িভাড়া পান। ব্যাংক ও অর্থলগ্নি
প্রতিষ্ঠান এবং বিচার বিভাগের কর্মকর্তারাও একইভাবে বেতন পান।
এই বেতনকাঠামো বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায়, সর্বোচ্চ
বেতনধারী কর্মকর্তারা ১২ হাজার টাকার মতো বাড়িভাড়া পান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
প্রশাসনের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের
একজন যুগ্ম সচিব প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি যে বেতনকাঠামো, সেই টাকা দিয়ে কোনোভাবেই একজন সরকারি
কর্মকর্তার ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়। বিষয়টি রীতিমতো হাস্যকর।
ঢাকা ভাড়াটিয়া উন্নয়ন
সোসাইটির মহাসচিব মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের এই বেতনকাঠামো বিশ্লেষণ করলে এটি
পরিষ্কার যে বাংলাদেশে দুর্নীতির একটি বড় কারণ রাজধানীর অতিরিক্ত বাসাভাড়া। সরকারি
একজন কর্মকর্তা যে বেতন পান, তাঁর পক্ষে সেই টাকা দিয়ে একটি মোটামুটি মানের বাসা নিয়ে সৎভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। কাজেই সরকারের উচিত
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করা।
কেবল সরকারি কর্মকর্তাই নন, নির্ধারিত আয়ের সব চাকরিজীবীর একই
সমস্যা। আয়ের বড় অংশই তাঁদের চলে যাচ্ছে বাসাভাড়ায়।
বেসরকারি একটি ব্যাংকে কাজ
করেন রাইসুল ইসলাম। তিনি সব মিলিয়ে বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাড়িভাড়া পান ছয়
হাজার টাকা। অথচ তাঁকে থাকতে হচ্ছে ১৪ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে। তিনি
বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, ঢাকার বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে
আমরা অনেক ভালোভাবে বাঁচতে পারতাম।
যাঁরা সমাজের দুর্নীতি ও
অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখেন, সেই সাংবাদিকদের বাড়িভাড়ার অবস্থাও করুণ। সর্বশেষ সপ্তম সংবাদপত্র
মজুরি বোর্ডের কাঠামো অনুযায়ী, একজন সাংবাদিকের ন্যূনতম বেতন ১৮ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া হিসেবে পান পাঁচ
হাজার টাকা। এই টাকায় ঢাকা শহরের কোথাও বাসাভাড়া পাওয়া অসম্ভব।
বেসরকারি সংস্থা নাগরিক
সংহতির এক জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীর নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ৫৭ শতাংশ মানুষকে আয়ের অর্ধেক খরচ করতে হচ্ছে
বাড়িভাড়ার পেছনে।
প্রতিবেদন: সংগ্রহ/প্র.আ