পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

খুলনায় প্রভাবশালীদের পেটে ৫ খাল


খুলনা নগরের চারপাশে বয়ে গেছে ২২টি খাল। একসময় খালগুলো দিয়ে নৌকা চলত কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল-বাণিজ্যে খালগুলো এখন রুগ্ণ, অনেকটা মৃতপ্রায়।
২২টি খালের মধ্যে পাঁচটির অবস্থা সবচেয়ে করুণ। দুই পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতঘরসহ নানা স্থাপনা। এমনকি খুলনা সিটি করপোরেশনও (কেসিসি) খালের জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ২৫-৩০ বছর ধরে চলছে এ অপতপরতা।
প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখন খালের জমি নিজেদের বলে দাবি করছেন। তবে কেসিসির ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দাবি সত্য নয়। এরই মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। অচিরেই অভিযান শুরু হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ দত্ত গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই খুলনা নগর বাঁধবেষ্টিত নিচু এলাকা। তার ওপর এই খালগুলো যত দিন দখলমুক্ত না হবে, তত দিন নগরে জলাবদ্ধতার সংকট দূর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফুজ্জামান শিগগিরই খালের জায়গা দখলমুক্ত করতে বৃহত্তর আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন।
গোড়া খাল (লবণচরা খাল): এটির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৪০-৫০ ফুট। দুই পাশের অধিকাংশ জায়গা দখল করে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় ৪৫ ব্যক্তি খালের জমিতে পাকা, কাঁচা, আধাপাকা স্থাপনা নির্মাণ করে বসবাস ও ব্যবসা করছেন।
১৯৯০ সালে লবণচরা এলাকার প্রভাবশালী আবদুল মালেক খালটির ইজারা নেন। তাঁর মৃত্যুর পর খালটির দখল-প্রক্রিয়া শুরু হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তি খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে প্লট তৈরি করে মানুষের কাছে বিক্রি করেছেন।
এর মধ্যে আবদুল মতিন, আ. সালাম ও আবদুর রহমান দাবি করেন, তাঁরা আবদুল মালেকের আত্মীয় সেকেন্দার মুহুরির কাছ থেকে খালের জমি কিনে বসবাস করছেন। তাঁদের কাছে জমির দলিলপত্র আছে। ১৯৯৯ সালে কেসিসি অবৈধভাবে খালটির লবণচরা এলাকায় ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ও নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকেন্দ্রের ভবন নির্মাণ করেছে।
মান্দার খাল: এটি নগরের বানরগাতি আল-আমিন মহল্লা দিয়ে ঢুকে শ্মশান ঘাটের পাশ দিয়ে ময়ূর নদে মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য দুই কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৫০-৬০ ফুট। এর প্রায় এক কিলোমিটার স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
কেসিসির ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদার জানান, মান্দার খালের বিশাল অংশ দখলে নিয়েছেন ১৩ জন। তাঁরা হলেন বন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা শাজাহান, স্থানীয় বাসিন্দা যশুয়া পাটোয়ারী, মোহন বাড়ই, চান মিয়া, বজলুর রহমান, হক বেপারী, রফিকুল ইসলাম, মকবুল হোসেন, মোস্তফা, মাহমুদা, হাবিবুল্লাহ ও মাহবুব মোর্শেদ।
দখলদারদের বিরুদ্ধে কেসিসি উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। কিন্তু তারা কেসিসির বিরুদ্ধে মামলা করলে আদালত উচ্ছেদের বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এ বিষয়ে শাজাহান দাবি করেন, খাল দখলের অভিযোগ সঠিক নয়। ওই জমি হালট (গরু-ছাগলের চারণক্ষেত্র)। ওই জমি নিয়ে আদালতে মামলা আছে।

গল্লামারী নর্থ ব্যাংক খাল: চার কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালটি ফারাজীপাড়া ময়লাপোতা মোড় থেকে গল্লামারী সেতুর পাশে ময়ূর নদে মিশেছে। এর প্রস্থ ২০-২৫ ফুট। দীর্ঘদিন খালের দুই পাশ দখল হওয়ার পর বর্তমানে প্রস্থ ৬-১০ ফুটে নেমে এসেছে। এই খালের জায়গা দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় জলিল তালুকদার, মো. নূর, মো. ইউসুফ, কাশেম সরদার, বক্কার, ওয়াহিদুজ্জামান ও আবু সাঈদসহ কয়েকজন খালের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
এ বিষয়ে জলিল তালুকদার, ওয়াহিদুজ্জামান ও বক্কার দাবি করেন, তাঁদের কাছে জমির কাগজপত্র আছে। তাঁরা বৈধভাবে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন।
এ খালে স্থাপনা নির্মাণ করায় নগরের বানরগাতি, পশ্চিম বানিয়াখামার, বসুপাড়া, ইকবাল নগর, সোলাইমান নগর ও ফারাজীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হলে পানি নামতে পারে না।
হরিণটানা নারকেলবাড়িয়া খাল: এটি নগরের হরিণটানা এলাকা দিয়ে নিরালা হয়ে ময়ূর নদে মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার ও প্রস্থ ৬০ ফুট। এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি খালের জায়গা দখলের পর প্লট তৈরি করে বিক্রি করেছেন।
তাঁদের মধ্যে আছেন খলিলুর রহমান, আবেদ আলী, ক্লিপ অধিকারী, শহিদুল ফকির, আবদুল মান্নান, সাহেব আলী, বাদল, চপল ও হেকমত গাজী।
খালের জায়গা দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে আবেদ আলী বলেন, ‘খালের জায়গা আমি দখল করিনি। খালের পাশে আমার একটি মুরগির খামারের ছাউনি ছিল, তা অনেক আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
মতিয়াখালী খাল: এটি খুলনা শিপইয়ার্ডের উত্তর পাশ দিয়ে রূপসা নদী দিয়ে বের হয়ে নগরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম টুটপাড়া ছড়িছড়া খালের সঙ্গে মিশেছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা খালের জায়গা দখল করে পশ্চিম টুটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণ করেন। এর বিভিন্ন অংশে বাঁধ বা পাটা দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এ ছাড়া খালের ওপর কেসিসি রাস্তাও নির্মাণ করেছে। খালের উভয় পাশের বাসিন্দারা অবৈধভাবে জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এ খালটির দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটার ও প্রস্থ ৫০-৬০ ফুট। তবে দখলের কারণে এখন খালটি বিভিন্ন স্থানে সরু নালায় পরিণত হয়েছে।
খাল দখলের বিষয়ে কেসিসির ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা ২২টি খালের মালিকানা জেলা প্রশাসনের। তবে এগুলো তদারকির দায়িত্ব কেসিসির। এর মধ্যে পাঁচটি খালের বেশ কিছু অংশ অবৈধ দখল হয়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য ১৪ মে প্যানেল মেয়র-১ আজমল আহমেদের সভাপতিত্বে কেসিসিতে সভা হয়। এতে দখল হয়ে যাওয়া খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে পিলার স্থাপন এবং রেকর্ড সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে খালগুলো পরিমাপ করে সীমানা নির্ধারণ ও পিলার স্থাপনের কাজ চলছে। এ ছাড়া খালের ওপর কেসিসির যেসব স্থাপনা আছে, তা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা আরও জানান, ২০০০ সালে শেষ হওয়া সর্বশেষ ভূমি জরিপে সরকারি এই খালগুলোর আয়তন কমিয়ে রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল অর্থের বিনিময়ে জরিপ কর্মকর্তাদের হাত করে সরকারি খালের জমি তাদের নামে রেকর্ড করিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শতাধিক আপত্তি দেওয়া হয়েছে। তবে আজও কোনো সুরাহা হয়নি।
প্রতিবেদন: সংগৃহীত এবং সম্পাদনা: পান্থ রহমান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন