পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ৬ জুন, ২০১২

বাংলাদেশ রাজি না হলে টিপাইমুখ বাঁধ নয় ॥ ভারতের পানিসম্পদ সচিব


বাংলাদেশ রাজি না হলে বরাক নদীর টিপাইমুখে একতরফা বাঁধ নির্মাণ করবে না ভারত। দেশটির পানিসম্পদ সচিব ধ্রুব বিজয় সিং ৪ জুন, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলেন সোমবার নয়াদিলি্লতে ভারতের কর্মকর্তারাও একই কথা জানিয়েছেন ভারত এই জলবিদ্যু প্রকল্পে বাংলাদেশকে অংশীদার হওয়ার প্রস্তাবও রাখছে বলে জানান তারা। এ প্রস্তাবে রাজি হলে বাংলাদেশ প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করে আনুপাতিক হাতে বিদ্যু পেতে পারে বলে জানানো হয়। এবং এর সম্ভাব্যতা যাচাই করতে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে টিপাইমুখ জলবিদ্যু প্রকল্পের ভালো-মন্দ যাচাই করতে বৈঠক করবেন বলেও জানা গেছে।

নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যদি কোনোভাবে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয় তবে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে ঢাকা 'গ্রিন সিগন্যাল' দেবে না। আর নাম প্রকাশ না করার শর্দে বাংলাদেশের এক উচ্চপদস্থ কূটনীতিক জানিয়েছেন, টিপাইমুখে উপাদিত বিদ্যুতের দাম এতটাই বেশি হবে যে, সেখানে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এ মুহূর্তে প্রকল্পটিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। পরে কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব হলে তখন ভিন্ন বিবেচনার প্রশ্ন আসতে পারে

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরের বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সইয়ের আট মাসের মাথায় চমকপ্রদ তথ্য জানালেন ধ্রুব বিজয় সিং কারণ বাংলাদেশের উদ্বেগ এবং মণিপুর ও পাশের রাজ্য মিজোরামের পরিবেশবাদীদের বিরোধিতার পরও গত ২২ অক্টোবর চুক্তিটি সই হয় দিল্লিতে চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানটিতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে ও মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ও ইবোবি সিং

দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্রে গতকাল জানা গেছে, মূলত আর্থিকভাবে প্রকল্পটি লাভজনক হবে না, এমন ধারণা থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে কারণ যে পরিমাণ অর্থ এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে অনেক বেশি তাই প্রকল্পটি লাভজনক না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি

গতকাল সকালে বাংলাদেশের এই সাংবাদিকদের সামনে চমকপ্রদ এক তথ্য তুলে ধরেছেন ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল তাঁর দাবি, প্রায় তিন দশক আগে বাংলাদেশই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাবটি দিয়েছিল সন্ধ্যায় এ দাবির সত্যতা জানতে চাইলে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম সুর মিলিয়েছিলেন তবে তাদের কেউই এ বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ দেখাতে বা সূত্র উল্লেখ করতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে পবন কুমার উপস্থিত পানিসম্পদসচিব ধ্রুব বিজয় সিংকে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহের নির্দেশ দেন। পরে ধ্রুব বিজয় সিং সাংবাদিকদের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ষষ্ঠ বৈঠকের যৌথ সম্মতিপত্রের একটি অনুলিপি সরবরাহ করেন। তবে সে কাগজটি পবন কুমার বানসালের দাবির সত্যতা প্রমাণ করে না

সম্মতিপত্রে দেখা যায়, ষষ্ঠ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বাংলাদেশ ও ভারতে বন্যানিয়ন্ত্রণের স্বার্থে বরাক বাঁধ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখবে এর জন্য দুই দেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা সিলেট, কাছাড় ও আশপাশের এলাকায় বন্যার প্রকোপ কমানো ও বন্যানিয়ন্ত্রণের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেকিন্তু ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম বিকেলে তাঁর দপ্তরে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে পবন কুমার বানসালের বক্তব্যকে সমর্থন করলেসাংবাদিকদের ৭২ ও ৭৮-এ অনুষ্ঠিত জেআরসি বৈঠকের দুটি যৌথ ঘোষণার অনুলিপি দিয়েছেন, যাতে ৭৪ সালের ওই বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্তের কথাটি উল্লেখ আছে

ভারতের পানিসম্পদসচিব বলেন, বৃহদায়তন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিপুল অর্থ দরকার ভারত নিজস্ব অর্থায়নে এটি করবে, কোনো দাতাগোষ্ঠীর টাকায় নয় কাজেই টাকার উসটা সীমিত তাই টিপাইমুখ প্রকল্পে সমস্যা দেখা দিলে, আমরা অন্য কোথাও এ ধরনের প্রকল্প করার কথা ভাবব

জলবিদূত নিয়ে ধ্রুব বিজয় সিং জানান, জলবিদ্যুপাদনের লক্ষ্যে টিপাইমুখ প্রকল্পটিতে ২২ হাজার হেক্টর জমিতে পানি সংরক্ষণ করা হবে এতে প্রায় ৯০০ কোটি কিউবিক লিটার পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে। মূলত বন্যার সময় পানি ধরে রেখে পরে ছাড়াই হবে এর কাজ। প্রকল্পে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তবে পানির প্রাপ্যতা অর্থা যে পরিমাণ পানি ধরে রাখা হবে, কেবল তার ভিত্তিতে বিদ্যুপাদিত হবে প্রকল্পটিতে সেচের ব্যবস্থা না থাকায় পানির গতি রোধের কোনো সুযোগ থাকছে না
ভারতের শ্রমশক্তি ভবনে বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সামনে টিপাইমুখ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনকালে ভারতের বিদ্যু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (জলবিদ্যু) জি সাই প্রসাদ জানান, 'ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে, বাংলাদেশকে সঙ্গে না নেওয়া পর্যন্ত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে না' এ সময় ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ধ্রুব বিজয় সিং উপস্থিত ছিলেনযদি বাংলাদেশ টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি জানায় তবে কি এই প্রকল্প নিয়ে ভারত এগিয়ে যাবে?-এমন প্রশ্নের জবাবে সিং স্পষ্ট করেছেন, বাংলাদেশকে সঙ্গে না নিয়ে তারা কিছু করবেন না সেখানে প্রজেক্টরের মাধ্যমে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) ভারতীয় অংশের সদস্য দেবেন্দ্র শর্মা তিনি প্রকল্পের ওপর উপস্থাপনা দিয়ে বলেছেন, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুপাদন এবং আবারও বলেন; সেচের কাজে পানি সরানোর কোনো উপাদান টিপাইমুখ প্রকল্পে নেই

টিপাইমুখ সম্পর্কে এই উপস্থাপনার আগেই শ্রমশক্তি ভবনে দুপুরের দিকে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বনসালের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের এই প্রবীণ নেতা তার নির্বাচনী এলাকায় ১০ দিন অবস্থানের পর সরাসরি এসে সফররত সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মিলিত হন এবং খোলামেলা কথা বলেন। তিনি জানান, সত্তরের দশকে বাংলাদেশ বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব তুলেছিল এখন এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুপাদনের লক্ষ্যে দুই দেশের সিদ্ধান্তের আলোকে এ মুহূর্তে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বৈঠকের আয়োজন চলছে বাংলাদেশ এজন্য ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ গ্রুপের তালিকা পাঠিয়েছে জুনের শেষ সপ্তাহেই এ ব্যাপারে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞরা বসছেন পবন কুমার বনসাল স্পষ্ট করেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরানোর কোনো পরিকল্পনা ভারতের সেই সেখানে সেচ প্রকল্পও নেই দুপুরে মৌর্য আইটিসি হোটেলে বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন এতে বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রজি মিত্র, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিষয়ক ডেস্কের যুগ্ম সচিব হর্ষবর্ধন সিংলাসহ কূটনীতিক ও ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা অংশগ্রহণ করেন

ভারতের উপস্থাপনায় বলা হয়, টিপাইমুখে জলবিদ্যু প্রকল্পে ১৬২ দশমিক ৮ মিটার উচ্চতার বাঁধ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুপাদনের লক্ষ্য রয়েছে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দুই বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রয়োজন হবে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে এ প্রকল্পটি ২১০ কিলোমিটার উজানে এতে ছয়টি টারবাইন থাকবে

তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যত: তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ই। তবে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি সই হয়নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে। তাঁর দাবি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে বেশি পানি দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার
এরপর গত নয় মাসেও এতে কোনো অগ্রগতি নেই তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বারবার বলছে, অভিন্ন নদীর পানি চুক্তি সইতে তাদের আন্তরিকতার কথা
সোমবারও একই প্রতিশ্রুতি দিলেন পবন কুমার বানসালও তিনি বলেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে উভয় দেশের সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে এবং যত দ্রুত সম্ভব এ চুক্তি সইয়ের জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য সরকারকে আস্থায় নিয়ে কাজ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাই পশ্চিমবঙ্গকে আস্থায় নিয়ে চুক্তি আমরা সই করতে চাই
এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বানসাল বলেন, এ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমাটা জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর আমরা সে লক্ষেই কাজ করছি তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানটা হচ্ছে তাঁর রাজ্যের মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে সব পক্ষই লাভবান হয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন