হঠাতই অনেক পেছনে নিয়ে গেলো লন্ডন অলিম্পিক। ইতিহাস থেকে দেখানো ছবি কিংবা আলোর ঝলকানি কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির চমক-ছিলো সবই। প্রায় চার ঘণ্টার চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুক্রবার
রাতে লন্ডনে শুরু হলো মর্ত্যের বুকে সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক গেমসের ত্রিশতম
আসর।
বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে দ্বিতীয়বারের
মতো অলিম্পিকের উদ্বোধন ঘোষণা করেন রানী এলিজাবেথ। এর আগে ১৯৭৬ সালে কানাডার রাণী হিসেবে মন্ট্রিয়েল অলিম্পিকের উদ্বোধন করেছিলেন
তিনি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রানীর স্বামী ডিউক অব এডিনবরা প্রিন্স ফিলিপ এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি)
সভাপতি জ্যাক রগ উপস্থিত ছিলেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন রগ,
আর স্বাগত বক্তব্য দেন আয়োজক কমিটির সভাপতি সেবাস্টিয়ান কো।
রাণীর ঘোষণার পরপরই আতশবাজির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে
অলিম্পিক স্টেডিয়ামের আকাশ। অলিম্পিক পতাকা ওড়ানোর সময়
উপস্থিত ছিলেন বক্সিং গ্রেট মোহাম্মদ আলী।
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর আগে ৮ হাজার বহনকারীর
হাত ঘুরে ৮ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে মশাল। স্পিড বোটে করে তরুণ ফুটবলার জেন বেইলি মশাল নিয়ে আসেন স্টেডিয়ামে। ঐ বোটের চালক ছিলেন ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহাম। বেইলির কাছ থেকে মশাল নেন রোয়িংয়ে ৫টি অলিম্পিক সোনা জয়ী স্যার স্টিভ রেডগ্রেভ।
এ সময় অ্যাথলেটদের পক্ষে শপথ পাঠ করেন তায়কোয়ান্দো
তারকা সারাহ স্টিভেনসন। রেফারিদের শপথ পাঠ করেন মাইক বাসি ও কোচদের শপথ পাঠ
করেন এরিক ফেরেল এমবিই।
স্যার রেডগ্রেভ মশাল তুলে দেন সাত তরুণ অ্যাথলেটের
একটি দলের হাতে। তারা পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করে প্রজ্বালন করেন স্টেডিয়ামের
মূল মশাল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের শতাধিক
দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে মর্যাদার ক্রীড়া আসর অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শৈল্পিক দক্ষতায় তুলে
আনা হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইতিহাস। ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে এক
হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবীর অংশ গ্রহণে দেখানো হয়েছে যুক্তরাজ্যের অবদান।
এর আগে স্থানীয় সময় রাত আটটা বারো মিনিটে বিশ্বের
সবচেয়ে বড় ও নিখুঁতভাবে ‘টিউনিং’ করা একটি ঘন্টার ধ্বনি বাজিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ঘন্টা বাজান ট্যুর ডি ফ্রান্স জয়ী ব্র্যাডলি উইগিন্স।
অস্কার বিজয়ী সুরকার ড্যানি বয়েল বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানে
অনন্য দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন আধুনিক প্রযুক্তি। তার পরিচালনায় বিস্ময়ের দ্বীপ অনুষ্ঠানের শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাজ্যের গ্রামীণ
সবুজ ও সমাহিত পটভূমি। খামারের আসল গবাদি পশুই ব্যবহার করেন বয়েল। দেখানো হয় গ্রামীণ ক্রিকেট ম্যাচও।
জেরুসালেম, ড্যানি বয়, ফ্লাওয়ার অব স্কটল্যান্ড ও ব্রেড অব হেভেন- এই চার
গানের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের চার দেশকে তুলে ধরা হয়েছে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অমর নাটক টেমপেস্টের ছোট্ট অংশ এ সময় ব্যবহার করেন বয়েল। নিপুণ দক্ষতায় দেখানো হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব।
এরপর বড় পর্দায় দেখানো হয় সিক্রেট এজেন্ট জেমস বন্ডের
একটি শর্ট ফিল্ম। এর শেষ পর্যায়ে একটি হেলিকপ্টারে করে ইংল্যান্ডের
রাণী এলিজাবেথকে নিয়ে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে পৌঁছান বর্তমান বন্ড ড্যানিয়েল ক্রেইগ। রাণী স্টেডিয়ামে আসার পরপরই বেজে ওঠে ইংল্যান্ডের জাতীয় সংগীত।
পরের পর্বটি শিশুদের। জেকে রাওলিংয়ের জনপ্রিয় চরিত্র জাদুকর হ্যারি পটার ও তার প্রধান শত্র“ লর্ড ভলডারমট আরেকবার মুখোমুখি হন অলিম্পিকের উদ্বোধনী আসরে। বরাবরের মতো হেরেই বিদায় নিতে হয় ভলডারমটকে। ছিলেন ছোট-বড় সবার প্রিয় চরিত্র মিস্টার বিন খ্যাত রোয়ান অ্যাটকিনসন।
যুক্তরাজ্যের সংস্কৃতি ও তার বিবর্তনকে তুলে ধরার
সম্ভাব্য চেষ্টাই করেছেন বয়েল। গ্রামীণ সংস্কৃতি তুলে ধরার
পর ব্যস্ত নগর জীবনের অস্থির তারুণ্য ও হালের পপ-সংস্কৃতিতেও সামনে নিয়ে আসেন তিনি। এ সময় জনপ্রিয় গান আর চলচ্চিত্রের ফুটেজ ব্যবহার করা হয়। শিল্পের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের গ্ল্যামার জগৎকেও সমানভাবে তুলে ধরা হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
সর্বক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের সফল ব্যক্তিদের সামনে নিয়ে
আসার চেষ্টা করেছেন বয়েল। অলিম্পিক মন্ত্রী জেরেমি হান্ট
একেই বলেছেন, যুক্তরাজ্যের বৃহৎ একক বিজ্ঞাপন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বা ডব্লিউডব্লিউডব্লিউর
জনক স্যার টিমোথি বার্নার্স লিও ছিলেন মঞ্চে।
শুধু হালকা বিষয় দেখানোই নয়, জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে মানুষের সংগ্রামকে সামনে নিয়ে এসেছেন তিনি। কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের নেতৃত্বে ৫০ সদস্যের একটি দলের এই পরিবেশনার পরপরই শুরু
হয় দলগুলোর মার্চপাস্ট।
ঐতিহ্য মেনেই সবার আগে মার্চপাস্টে অংশ নেয় গ্রিস,
এরপর বর্ণক্রম অনুসারে আসে অন্যরা। এর আগে ১৮৯৬ সালের এথেন্স অলিম্পিকের মশাল প্রজ্বালনের দৃশ্য দেখিয়ে বর্তমানে ফেরানো
হয় দর্শকদের। ৭০ দিনের মশাল র্যালির একটি ভিডিও চিত্রও দেখানো হয়
এ সময়।
বাংলাদেশের পতাকা বহন করেন সাঁতারু মাহফিজুর রহমান
সাগর। বাংলাদেশের অন্য চার প্রতিযোগী হলেন শারমিন আক্তার রত্না, ইমদাদুল হক মিলন, মোহন খান ও সাইক সিজার। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তাদের অভিনন্দন জানান।
১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে শনিবার লড়বেন রত্না। এর আগে শুক্রবার আর্চারির বাছাই পর্বে অংশ নিয়ে ৬১তম হয়েছেন মিলন।
সবার শেষে মার্চপাস্টে আসে স্বাগতিক যুক্তরাজ্য। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, প্রিন্স উইলিয়াম ও তার
স্ত্রী কেট মিডলটন এবং দর্শকরা তাদের অভিনন্দন জানান।
এটি লন্ডনে তৃতীয় অলিম্পিক। এর আগে ১৯০৮ ও ১৯৪৮ সালে অলিম্পিক আয়োজন করেছিল ইংল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের রাজধানী।
স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১২ মিনিটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
শুরু হওয়ার ১২ ঘন্টা আগে ৩ মিনিটে ৪০ বার ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে বিগ বেন ঘোষণা করে অলিম্পিকের
আগমনী বার্তা। ৬০ বছর পর প্রতি ঘন্টায় ঘণ্টা বাজানোর ব্যতিক্রম করলো
বিগ বেন। এর আগে ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর
পর সর্বশেষ নির্ধারিত সময়ের বাইরে বেজেছিল বিগ বেন। শুধু লন্ডনের বিগ বেনই নয়, যুক্তরাজ্যের সব ঘণ্টাই বেজে
ওঠে এক সুরে।
নব নির্মিত অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বসে ৮০ হাজার ও টেলিভিশন
পর্দায় ১ বিলিয়ন দর্শক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
১৪ বিলিয়ন পাউন্ডের এই অলিম্পিকে ২৬টি খেলায় ৩০২টি
ইভেন্টে ২০৪টি দেশের ১৪ হাজার সাতশ প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছেন।
২ অগাস্ট সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরের। শুরু হবে ২০১৬ রিও ডি জেনিরো
অলিম্পিকের জন্য প্রতীক্ষা।
সংবাদ: সংগ্রহ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন