পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

হুমায়ূন আহমেদ: স্বপ্নযাত্রার সমাপ্তি!


চলে গেলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশ সময় আজ বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই, রাত সোয়া ১১ টার দিকে তিনি নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি....রাজিউন।
সংক্ষিপ্ত জীবন, তবু বন্য‍ঢ্য
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর; শীতের রাতে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে জন্ম হয় হুমায়ূন আহমেদের। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা; মা আয়েশা ফয়েজ গৃহিনী। হুমায়ূন প্রথম সন্তান।
তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। খ্যাতিমান কম্পিউটার-বিজ্ঞানী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ছোটভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখক।
ফয়জুর রহমানের চিন্তায় ছিল, তাঁর প্রথম সন্তান হবে মেয়ে। তিনি মেয়ের নামও ঠিক করে রাখেন। কন্যাসন্তানটির জন্য তিনি একগাদা মেয়েদের ফ্রকও বানিয়ে রাখেন। অথচ জন্ম নিলেন হুমায়ূন। তাঁর এই পুত্র সন্তানটিকেই ফয়জুর দীর্ঘদিন মেয়েদের সাজে সাজিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি তাঁর মাথার চুলও ছিল মেয়েদের মতো লম্বা। লম্বা চুলে মা বেণি করে দিতেন। বেণি করা চুলে রং-বেরঙের ফিতা পরে হুমায়ূন আহমেদের শৈশবের শুরু।

হুমায়ূন আহমেদের শৈশবের প্রথম অধ্যায়টি যতটা স্নেহ ও মমতায় কেটেছে, দ্বিতীয় অধ্যায়টি কেটেছে ততটা বঞ্চনার ভেতর দিয়ে। শৈশবে তাঁর মা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর থেকে সুস্থ হওয়ার পর তাঁর স্মৃতিভ্রম দেখা দেয়। তিনি কাউকেই চিনতে পারছেন না, এমনকি তাঁর ছেলেকেও না। ফলে হুমায়ূন আহমেদকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে। সেখানে দুই বছর তিনি নানা-নানির আদরে বেড়ে ওঠেন।
দুই বছর পর মা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর ১০ বছর বয়স পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে হেসে-খেলে। বাবার চাকরি সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তিনি শৈশব কাটিয়েছেন।
সিলেট থেকে বাবা বদলি হন দিনাজপুরের জগদ্দলে। জঙ্গলের ভেতর এক জমিদার বাড়িতে তাঁরা থাকতেন। জগদ্দলের দিনগুলি তাঁর কাছে ছিল হিরণ্ময়। বাবার সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতেন হুমায়ূন। গুলিভর্তি রাইফেল হাতে বাবা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতেন। ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প আলো আসত। থমথমে পরিবেশ। বিচিত্র সব পাখি ডাকত। বুনো ফুলের গন্ধ। পরিষ্কার বনে চলার পথ। বিচিত্র বুনো ফল। জঙ্গল পেরোলেই নদী। চকচকে বালির ওপর দিয়ে স্বচ্ছ পানি বয়ে যেত। দুপুরে সেই নদীতে গোসল করতেন। একবারেই আলাদা এক জীবন।

আবার বদলি পঞ্চগড়ে। সেখানে ভোরবেলা বাসার সামনে দাঁড়ালে কাঞ্চন জঙ্ঘার তুষার-শুভ্র চূড়া চোখের সামনে ঝলমল করে উঠত। পঞ্চগড় থেকে এবার রাঙামাটি। পাহাড়ি উপত্যকায় আবার সেই উদ্দাম ঘুরে বেড়ানোর দিন। হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে এমনি স্বপ্নময়তার ভেতর দিয়ে।
শৈশবে হুমায়ূন আহমেদ যত জায়গায় গেছেন তার মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল দিনাজপুরের জগদ্দল। এর প্রধান কারণ ছিল, তাঁরা যেখানে থাকতেন তার আশপাশে কোনো স্কুল ছিল না। স্কুলের কথা মনে হলেই হুমায়ূন আহমেদের মুখ তেতো হয়ে যেত। মা-বাবা তাঁকে স্কুলে পাঠাতেন বটে, তবে স্কুলে সময় কাটাতেন কেবল দুষ্টুমি করে। টেনেটুনে পাস করতেন।
প্রাইমারি স্কুল পাসের পর এই হুমায়ূন বদলে যান। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে স্কুলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। আগ্রহটা এমনই ছিল যে এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর দেখা গেল, তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি পরীক্ষায়ও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময় ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপক যোসেফ অ্যাডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। লেখালেখি ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত সময় দেওয়ার জন্য পরবর্তী সময় অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে দেন জনপ্রিয় শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ।
কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় নন্দিত নরকে উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ। নন্দিত নরকে যখন প্রকাশ হয়, তখনই বোঝা গিয়েছিল কথাসাহিত্যের কঠিন ভুবনে তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি। তাঁর এই অমিত সম্ভাবনা তখনই টের পেয়ে প্রখ্যাত লেখক-সমালোচক আহমদ শরীফ এক গদ্যের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আহমদ শরীফের প্রশংসা যে অপাত্রে ছিল না, তা তো আজ সর্বজনবিদিত।
মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা সহজ-সরল গদ্যে তুলে ধরে তিনি তাঁর পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। শুধু মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা বয়ানেই সীমিত নয় তাঁর কৃতিত্ব, বেশ কিছু সার্থক সায়েন্স ফিকশনের লেখকও তিনি। জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমুর স্রষ্টা তিনি।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের ভিতটা গড়ে ওঠে পারিবারিক বলয় থেকেই। তাঁর বাবা ছিলেন সাহিত্যের অনুরাগী। বাসায় নিয়মিত সাহিত্য আসর বসাতেন। সেই আসরের নাম ছিল সাহিত্য বাসর। গল্প লেখার অভ্যাসও ছিল তাঁর। যদিও সেসব গল্প কোথাও ছাপা হয়নি। তবে গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হয়েছিল। সন্তানদের মধ্যে যাতে সাহিত্য বোধ জেগে ওঠে, সে চেষ্টা করেছেন তাঁর বাবা। মাঝেমধ্যে তিনি নির্দিষ্ট একটা বিষয় দিয়ে ছেলেমেয়েদের কবিতা লিখতে বলতেন। ঘোষণা করতেন, যার কবিতা সবচেয়ে ভালো হবে, তাকে দেওয়া হবে পুরস্কার।
হুমায়ূন আহমেদের বড় মামা শেখ ফজলুল করিম যিনি তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন এবং যিনি ছিলেন তাঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তিনি কবিতা লিখতেন, লিখতেন নাটক এবং সেই নাটক তিনি তাঁর ভাগনে-ভাগনিদের দিয়ে বাসায় গোপনে গোপনে মঞ্চস্থও করাতেন। আর হুমায়ূন আহমেদের নিজের ছিল গল্প, উপন্যাসের প্রতি অসাধারণ টান।
হুমায়ূন আহমেদের পড়া প্রথম সাহিত্য ক্ষীরের পুতুল। যদিও তাঁর বাবার বিশাল লাইব্রেরি ছিল। কিন্তু সব বই তিনি তালাবদ্ধ করে রাখতেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁর সন্তানদের এসব বই পড়ার সময় এখনো হয়নি। কিন্তু ক্ষীরের পুতুল পড়ার পর তিনি তাঁর বাবার বইয়ের আলমারি থেকে বই চুরি করে লুকিয়ে পড়তে শুরু করলেন এবং একদিন বাবার হাতে ধরা পড়ে গেলেন। বাবা তাঁকে নিয়ে যান সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ সেখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বই আর বই। বাবা তাঁকে লাইব্রেরির সদস্য করে দেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন এই লাইব্রেরির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।

যদিও হুমায়ূন আহমদের প্রথম রচনা নন্দিত নরকে, তবে তারও বহু পূর্বে দিনাজপুরের জগদ্দলে থাকা অবস্থায় একটি কুকুরকে নিয়ে তিনি বেঙ্গল টাইগার নামে একটি সাহিত্য রচনা করেছিলেন। ১৯৭২ সালে লেখেন নন্দিত নরকে। তারপর একে একে শঙ্খনীল কারাগার, রজনী গৌরিপুর জংশন, অয়োময়, দূরে কোথাও, ফেরা, কোথাও কেউ নেই, আমার আছে জল, অচিনপুর, এইসব দিনরাত্রিসহ দুই শতাধিক উপন্যাসের জনক তিনি।
কেবল অধ্যাপনা আর কথাসাহিত্যই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণী। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া বিদেশি ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
টিভি নাট্যকার হিসেবেও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক এইসব দিনরাত্রি তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। হাসির নাটক বহুব্রীহি এবং ঐতিহাসিক নাটক অয়োময় বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক কোথাও কেউ নেই এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। নাটকের শেষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এমনটি আর কখনো হয়নি।

নাট্যকার- নির্দেশক দুই ভূমিকায়ই সমান সফল ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সফল শিল্পের আরেকটি শাখা চিত্রকলাতেও। তাঁর চিত্রশিল্পের স্বাক্ষর নিজ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো রয়েছে।
১৯৭৩ সালে গুলতেকিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। শাওন ১৯৯০ সাল থেকে টিভিতে অভিনয় শুরু করেন।

বালক হুমায়ূন আহমেদ ভালোবাসতেন গাছপালা শোভিত সবুজ অরণ্যানীর ভেতর ঘুরে বেড়াতে, বেটোফেনের সুরের মতন টিনের চালে বৃষ্টি শব্দ শুনতে। এই বয়সে ও তাঁর সবুজের ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হত, ইচ্ছে হত বৃষ্টি শব্দের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। ইট কাঠের খাঁচায় বন্দী এই রাজধানী ঢাকা তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসত। তাই তিনি গাজীপুরের শালবনের ভেতর তৈরি করেছেন এক বিশাল নন্দন কানন নুহাশ পল্লি। তাঁর বেশির ভাগ সময়ই কাটত নুহাশ পল্লির শাল গজারির সাথে কথা বলে, বৃষ্টির শব্দের সাথে মিতালি করে।

হুমায়ূনের উপন্যাসগুলো: নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খ নীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথায়, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাব যাব, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি।
হুমায়ূনের চলচ্চিত্র: আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারি, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত।
হুমায়ূনের পুরস্কার: একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮)।

তথ্যসূত্র: gunijan.org.bd

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন